গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো। Mojo Education bengali

 গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।  Mojo Education bengali


■ উত্তর। সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, মাত্র এক শতক পরেই তা পতনের পথে - হাবিত হয়। কোনো সাম্রাজ্যের উত্থান যেমন আকস্মিক বা একদিনে হয়নি, তেমনি পতনও একদিনে বা একটিমাত্র কারণে ঘটেনি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পেছনেও তাই একাধিক কারণের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়।


(১) দুর্বল উত্তরাধিকার: দুর্বল ও অযোগ্য উত্তরাধিকার গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য


বিশেষভাবে দায়ী ছিল। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ রাজার যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি রাজ্যের উন্নতি ও সংহতির প্রধান শর্তরূপে বিবেচিত হয়। চন্দগুপ্তকে এই বংশের 'শেষ শক্তিশালী সম্রাট' বলে অভিহিত করা যেতে পারে। পরবর্তী শাসকেরা ছিলেন দুর্বল। যোদ্ধা বা শাসক কোনো দক্ষতাই তাঁদের ছিল না। ফলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল, তেমনি বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল। শেষদিকের রাজাদের অধিকাংশই ছিলেন অদক্ষ ও দূরদৃষ্টিহীন। উদাহরণস্বরূপ, রাজা বালাদিত্যে'র কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি মায়ের অনুরোধে পরাজিত ও বন্দি হুননেতা মিহিরকুলকে মুক্তি দেন। এটি তাঁর মনের উদারতা প্রকাশ করলেও সাম্রাজ্যের পক্ষে ছিল চরম ক্ষতিকর। কারণ পরবর্তীকালে মিহিরকুল অত্যাচার করে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন, তা যশোবর্মন, প্রভাকরবর্মনদের স্বাধীনতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল।


(২) সামন্ত রাজাদের বিদ্রোহ: প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। গুপ্ত শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা বহুলাংশে মেনে নিয়েছিল। সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত কিছু রাজাকে নিয়মিত করদান ও আনুগত্যের বিনিময়ে হৃতরাজ্য ও ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে এই ধারার সূচনা করেছিলেন। অবশ্য তাঁর সামনে 'সামন্ত' কথাটি ব্যবহৃত হয়নি বা ওই ধরনের শাসকরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গুপ্তরাজাদের দুর্বলতার সুযোগে এই ধরনের সামন্তরাজার সংখ্যা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এঁদের কেউ কেউ 'রাজা' উপাধিও নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দুর্বল গুপ্তরাজাদের আমলে অধিকাংশ সামন্তরাজা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের ঐক্য বিনষ্ট হয়। বলভীর মৈত্রক, কনৌজের মৌখরি, থানেশ্বরের বর্ধন প্রভৃতি একে একে গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।


(৩) ত্রুটিপূর্ণ ভূমিদান ব্যবস্থা: ত্রুটিপূর্ণ ভূমিদান ব্যবস্থা গুপ্ত বংশের দুর্বলতাকে ঘনীভূত করেছিল। মৌর্যযুগে দানকৃত ভূমির নীচে অবস্থিত খনিজ পদার্থে রাজার অধিকার বজায় থাকত। একইভাবে দানকৃত গ্রামের প্রশাসনিক কর্তৃত্বও রাজার হাতে থাকত। কিন্তু গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ বা কোনো সংস্থাকে ভূমিদান করলে, সেই ভূমির ওপর রাজার কোনোরূপ দাবি থাকত না। এমনকি ওই ভূমির প্রশাসনিক কর্তৃত্বও দানগ্রহীতার ওপর বর্তাত। 

ফলে গুপ্তযুগে একশ্রেণির নতুন ভূম্যধিকারীর সৃষ্টি হয়েছিল, যারা কালক্রমে রালার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে শুরু করেছিল।


(৪) দুর্বল সেনবাহিনীঃ গুপ্তযুগে রাজাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কোনো সুগঠিত সেনাবাড়িও চাহিল ছিল কিনা, তা জানা যায়নি। এমনকি 'হরিষেণ-প্রশস্তি'তেও গুপ্ত সৈন্যবাহিনীর কোনে উল্লেখ নেই। তা ছাড়া, গুপ্তযুগে সৈন্যদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের মান সম্পর্কেও সঠিক জান মায়োন। পুষ্যমিত্র বা হুন-আক্রমণকারীদের ব্যবহৃত উন্নত অস্ত্রের মোকাবিলা করার মধে অস্ত্র খুবসম্ভব গুপ্তদের ছিল না। যাই হোক, সম্ভবত গুপ্তরাজাদের বাহিনীর জন্য সামন্তরাজাদের ওপর নির্ভর করতে হত। এই ধরনের নির্ভরতা যে রাজ্যের শক্তির প্রমাণ বহন করেন। তা বলাই বাহুল্য।


(৫) অভিজাতদের বিলাসব্যসনঃ বিলাসব্যসন-এর আধিক্য গুপ্ত রাজপুরুষদের বহুলাংশে কর্মবিমুখ ও অনর্থক শান্তিকামী করে তুলেছিল। ব্যাবসাবাণিজ্যের বৃদ্ধির ফলে মধ গুপ্তযুগে অভিজাত ও সামন্তদের মধ্যে বিলাসবৈভব অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। যে অভিজাত শ্রেণি অতীতে বিচক্ষণ মন্ত্রী বা সুদক্ষ যোদ্ধার জন্ম দিয়েছিল, তারাই পরবর্তীকালে বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবার ফলে দেশ ক্ষাত্রশক্তিহীন হতে শুরু করে।


(৬) অহিংস নীতির প্রাধান্য: গুপ্তরাজাদের অহিংস নীতির প্রতি আকর্ষণ ও বৌদ ধর্মমতের প্রতি অনুরাগ গুপ্ত শাসনকে প্রথমদিকের 'রক্ত ও লৌহ' নীতি থেকে সরিয়ে এনেছিল। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, তথাগত গুপ্ত, নরসিংহ গুপ্ত প্রমুখ গুপ্তরাজাগণ। বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অহিংসার অনুগামী হয়ে পড়েন। এঁরা বস্তুত নিষ্ক্রিয়তাকেই বরণ করে নেন। ফলে সামরিক শক্তি দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত সাম্রাজ্য তার মূলাধার। হারিয়ে ফেলে।


 গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।  Mojo Education bengali


Post a Comment

Previous Post Next Post