হরপ্পা-সংস্কৃতির (সিন্ধু-সভ্যতা) অবলুপ্তির কারণগুলি বিশ্লেষণ করো। mojo education bengali

 কোনো উন্নত সভ্যতা কোনো একটি কারণে বা একদিনে ধ্বংস হয়নি। একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে যেমন বহু মানুষের বহু আত্মত্যাগের এক বা একদিনে তমনি ওই সভ্যতার অবলুপ্তি ঘটাতো ছাড়া হরপ্পা-সভ্যতার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। তা ছাড়া সিন্ধু-উপত্যকা জুড়ে যে উন্নত রেডি নির্ধারণ করতে গিয়ে পন্ডিতগণ কোনো বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। ধ্বংসস্তূপে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, শুধুমাত্র বহিরাগত কারণে তার পতন সম্ভব ছিল না। এজন্য অবশ্যই দায়ী ছিল তার অভ্যন্তরীণ ত্রুটি বা দুর্বলতা। সিন্ধু-সভ্যতার অবলুপ্তির কারণ শালে আবিষ্কৃত বিভিন্ন নিদর্শন বিশ্লেষণ করে পন্ডিতগণ হরপ্পা-সংস্কৃতির অবলুপ্তির কারণ হিসেবে ভাত একাধিক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।



(১) মানসিক ও আর্থিক বন্ধ্যাত্ব: অনেকের মতে, বন্ধ্যাত্ব ছিল হরপ্পা-সংস্কৃতির ভাজা পতনের প্রধান কারণ। এঁদের মতে, সিন্ধু-উপত্যকায় এই বন্ধ্যাত্ব শুরু হয়েছিল মানসিক বদ্ধি দিক থেকে এবং পরিণতি লাভ করেছিল অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্বে। সিন্ধুবাসীরা ব্যাবিলন বা ধায় সুমেরের খালের জল দ্বারা সেচব্যবস্থার মাধ্যমে চাষের পদ্ধতি সম্পর্কেও যথেষ্ট অবহিত খুলে ছিল। কিন্তু নিজেদের এলাকায় এই পদ্ধতি প্রয়োগের কোনো উদ্যোগ তাদের ছিল না। এর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের কারিগরি কৌশলও সিন্ধুবাসীর আয়ত্ত ছিল। কিন্তু উপযুক্ত এবং প্রায় প্রয়োজনীয় অস্ত্রাদি নির্মাণে এদের কোনো প্রচেষ্টা ছিল না। এইভাবে গুটিয়ে থাকার প্রবণতা সিন্ধুবাসীকে আর্থিক ও সামরিক-উভয় ক্ষেত্রেই পঙ্গু করে তুলেছিল। এরই


অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল সভ্যতার অবলুপ্তি। (২) ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন: কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, ভূপ্রকৃতির স্বাভাবিক


(natural) পরিবর্তন ছিল হরপ্পা-সংস্কৃতির বিলুপ্তির প্রধান কারণ। যুক্তি হিসেবে এঁরা বলেছেন, সিন্ধু-উপত্যকার নিকটবর্তী অঞ্চলে মরুভূমি থাকায় এই অঞ্চলও ক্রমশ শুকনো হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তা ছাড়া, মরুর প্রভাবেই সিন্ধু-অঞ্চলে ভূস্তরের নীচে জল ক্রমশ লোনা হতে থাকে। ফলে জমির উর্বরাশক্তি কমে যায়। এইভাবে জলাভাব মরুভূমি তৈরি করে এবং মরুভূমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে আসে অবশ্যম্ভাবী পতন।

(৩) প্রাকৃতিক বিপর্যয়: অনেকের মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেই হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংস হয়েছিল। জলবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করে এঁরা বলেছেন যে, সিন্ধু-উপত্যকার নিকটবর্তী অঞ্চলেই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল। সম্ভবত, ভূমিকম্পেই এই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। ঐতিহাসিক রাইক্স-এর মতে, "সিন্ধু-নদীর জল অবরুদ্ধ হবার ফলে ক্রমাগত বন্যা ও প্লাবন হচ্ছিল এবং এর ফলেই সিন্ধু-সভ্যতার বিলোপ ঘটেছিল।” এস. আর সাহানীর মতেও, "প্লাবন বা বন্যাই সিন্ধু-সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল।” খননকার্যের ফলে

অন্তত তিনবার বিধ্বংসী বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বন্যার প্রকোপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সিন্ধুবাসীরা ৪৩ ফুট চওড়া একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিল, পয়ঃপ্রণালীর উচ্চতা করা হয়েছিল ১৪ ফুট। কিন্তু সিন্ধু-নদীর ভয়াবহ বন্যা শেষ পর্যন্ত এই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হয়েছিল।

(৪) বনসম্পদের বিনাশঃ বন্যার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে সিন্ধুবাসীরা আরও অনেক বিপদ ডেকে এনেছিল। যেমন-বন্যার কারণেই মহেন-জো-দারো ও হরপ্পার অধিকাংশ বাড়ি ছিল পোড়া ইটের তৈরি। ইট পোড়ানোর জন্য এরা যথেষ্টভাবে বনজঙ্গল ধ্বংস করেছিল। বনাঞ্চল নষ্ট হওয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিস্বরূপ ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে কৃষিকাজের চরম অবনতি ঘটে। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রজেল-এর মতে, "বনাঞ্চল ধ্বংসের সাথে সাথে সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলের প্রাণীকুলও ধ্বংস হয়েছিল, একটি সভ্যতার টিকে থাকার জন্য যা ছিল অপরিহার্য।"

(৫) অনুন্নত কৃষিব্যবস্থা: কোনো কোনো ঐতিহাসিক ভেঙে-পড়া কৃষিব্যবস্থাকে হরপ্পা-সংস্কৃতির অবলুপ্তির প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এঁদের মতে, সিন্ধুবাসীরা খালের জলের মাধ্যমে চাষ-আবাদ করত না। এরা বড়ো বড়ো জলাধারে বন্যার জল ধরে রাখত এবং প্রয়োজনে ওই জল চাষের কাজে লাগাত। কিন্তু বৈদেশিক শত্রুরা ওইসব জলাধারগুলি ভেঙে দিলে সিন্ধু-অঞ্চলের চাষ-আবাদ দারুণভাবে হ্রাস পায় এবং তার ফলে অনিবার্য পতনের দিকে এগিয়ে যায় সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা। কিন্তু অনেক সমালোচক এই তত্ত্বকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। যুক্তি হিসেবে এঁরা বলেছেন যে, সমগ্র সিন্ধু-উপত্যকার অবলুপ্তি একই সাথে ঘটেনি। যেমন, কাথিয়াবাড় অঞ্চলের পতন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় হরপ্পা-সংস্কৃতি আর্যদের আগমন পর্যন্ত অটুট ছিল।

(৬) গৃহযুদ্ধ: অনেকের মতে, হরপ্পা-সংস্কৃতির অবসান ঘটেছিল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। উপত্যকা-অঞ্চলে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত স্তূপীকৃত কঙ্কাল, মাথায় ভারী আঘাতের ফলে মৃত কঙ্কাল প্রভৃতি এই মতকে সমর্থন করে। কিন্তু এই রক্তপাত কেন ঘটেছিল, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিক এম. ট্যাডির মতে, গৃহযুদ্ধ বা গোষ্ঠীদ্বন্দুই ছিল এই হত্যাকাণ্ডের কারণ। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণের ফলেই এই হত্যকাণ্ড ঘটেছিল। অর্থাৎ বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধ অথবা বহিঃশত্রুর আক্রমণ-এই সুপ্রাচীন সভ্যতার পতন ঘটিয়েছিল।

(৭) বৈদেশিক আক্রমণ : বহিঃশত্রুর আক্রমণকে হরপ্পা-সংস্কৃতির পতনের কারণ হিসেবে অনেকেই গুরুত্ব দেন। তবে এই আক্রমণকারী কারা, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। এইচ. ডি. ওয়েল্স, মটিমার হুইলার প্রমুখের মতে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত আর্যদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলেই হরপ্পা-সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে প্রাপ্ত সিন্ধু-সভ্যতার বিলুপ্তির কাল ও আর্যদের ভারতে আগমনের কালের

সমসাময়িকতা এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। সিলু-উপত্যকার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত কিছু মাথার খুলিতে ভারী আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবার ঝুকারে প্রাপ্ত সিলে সোজা ও ঋজু রক্তযুক্ত যে কুঠারের চিত্র পাওয়া গেছে, তাকে 'বহিরাগত আর্যদের অস্ত্র' বলেই অনেকে চিহ্নিত করেছেন। ঋগ্বেদে বর্ণিত 'হরিগুপি'র যুদ্ধকে 'আর্যদের সাথে হরপ্পার মূদ্ধ' বলে অনেকে মনে করেন। তা ছাড়া, ঋগ্বেদে দেবতা ইন্দ্রকে 'পুরন্দর' বা 'নগরের ধ্বংসকারী' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, আর্যদের আগমনকালে ভারতে সিন্ধু-সভ্যতা ছাড়া অন্য কোনো নগর-সভ্যতা ছিল না। তাই ধরা যেতে পারে, ঋগবেদের দেবতা ইন্দ্র (পুরন্দর) সিন্ধুর নগর-সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিলেন। অবশ্য বৈদেশিক আক্রমণকারীরা শুধুমাত্র আর্যরাই ছিল-এই তথ্য মানতে রাজি হননি ঐতিহাসিক এ. ব্যাসাম।


Post a Comment

Previous Post Next Post