হরপ্পা সংস্কৃতির বা সিধু-সভ্যতার স্রষ্টা কারা? Mojo Education bengali

পূর্ব-পশ্চিমে আলমগিরপুর (দিল্লির নিকটে) থেকে সুতকা-গেনদোর পর্যন্ত এবং উত্তর-দক্ষিণে আম্বালা জেলার বুপার থেকে কিম নদীর তীর পর্যন্ত প্রসারিত হরা সভ্যতার জীবনধারা, ভাষা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদির বিচার করে তার স্রষ্টা কারা, তা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি।


(১) আর্যজাতি তত্ত্বঃ একদল পণ্ডিত মনে করেন যে, হরপ্পা-সংস্কৃতি বৈদিক সংস্কৃতির অংশবিশেষ। বৈদিক আর্যজাতি হরপ্পার স্রষ্টা। কিন্তু ব্যাসাম-সহ বহু পণ্ডিত যুক্তি দ্বারা এই মত খণ্ডন করেছেন। এঁদের মতে, আর্যরা যদি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা হয়ে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর পূর্বে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু ইতিহাসগতভাবে এই কথা কখনোই মানা যায় না। তা ছাড়া, আর্য-সভ্যতা ছিল মূলত গ্রামীণ। কিন্তু সিন্ধু-সভ্যতা ছিল নগরভিত্তিক। এমনকি ধাতু ব্যবহারের ক্ষেত্রেও

 প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের উপাদান ও সিন্ধু-সভ্যতা

উভয়ের মধ্যে ফারাক ছিল। যেমন হরপ্পা-সংস্কৃতিতে লোহার প্রচলন ছিল না, কিন্তু আর্যরা ১৯ লোহার ব্যবহার জানত। তাই স্যার জন মার্শাল মন্তব্য করেছেন যে, "বৈদিক-সভ্যতা, টির ফ্রি-সভ্যতা অপেক্ষা কেবল পরবর্তীই নয়: সম্পূর্ণ বিজাতীয় এবং স্বতন্ত্রও বটে।'


(২) সুমেরীয় তত্ত্বঃ অপর একজন পন্ডিত সুমেরীয়দের হরপ্পা-সভ্যতার স্রষ্টা বলে এক প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সুমেরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য, উভে দাদীমাতৃক চরিত্র প্রভৃতিকে এঁরা নিজেদের মতের সমর্থনে যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু মার্শাল, ব্যাসাম প্রমুখ ঐতিহাসিকরা উভয় সভ্যতার মধ্যে একাধিক প্রভেদ ও গাওস্থা উল্লেখ করে এই মতেরও বিরোধিতা করেছেন।


(৩) উপজাতি তত্ত্ব: আবার কেউ কেউ ব্রাবুই, অসুর, নাগ প্রভৃতি জাতিকে বহরয়া-সংস্কৃতির স্রষ্টা রূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা এমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপিত এবার করতে পারেননি, যা তাঁদের মতকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।


(৪) দ্রাবিড় তত্ত্বঃ অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, দ্রাবিড় জাতি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা। এঁরা যুক্তি হিসেবে বলেছেন যে, প্রাক্-আর্য দ্রাবিড় জাতি সমগ্র ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতেও তাদের বিস্তৃতি ছিল ধরা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে মোঙ্গলীয় ও আলপাইন জাতির মিশ্রণ দেখা এ যায়। হরপ্পা-সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ থেকেও ওইরূপ শারীরিক গঠনসম্পন্ন মানুষের প্রাধান্য প্রমাণিত হয়েছে। ঐতিহাসিক জাঁ ফিলিওজা বলেছেন যে, 'আর্য-পূর্ব ভারতীয় জনগণের মধ্যে দ্রাবিড় ও মুগুাই ছিল প্রধান। মুন্ডারা ছিল অসংস্কৃত ভাষী, কিন্তু দ্রাবিড়রা ছিল ব উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। এদিকে হরপ্পা-সংস্কৃতিও ছিল উন্নত। তাই এর স্রষ্টা হিসেবে এর দ্রাবিড়দের শনাক্ত করলে অযৌক্তিক হবে না। ধর্মগত বিষয়েও এই দুই সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। শিব-শক্তি ও লিঙ্গ-পূজা উভয় সংস্কৃতিরই অঙ্গ ছিল। বিখ্যাত লিপি-বিশারদ ফাদার হেরাস-এর মতে, হরপ্পা-লিপি প্রাচীন তামিল লিপির আদি রূপ। অবশ্য এই মতের বিরুদ্ধেও যুক্তির অভাব নেই। যেমন, উভয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-পদ্ধতি ■ এক নয়। দ্রাবিড়জাতির মধ্যে মৃতদেহ সমাহিত করার রীতি প্রচলিত ছিল; কিন্তু সিন্ধু-উপত্যকা খনন করে 'শবদাহ'-রীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া, দ্রাবিড় জাতি দক্ষিণ ভারতে - একটি সভ্যতার ধারক ও বাহক ছিল। তাই তারা যদি হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা হত, তাহলে সিন্ধু-উপত্যকা অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শনের অনুরূপ নিদর্শন কিছু না-কিছু দক্ষিণ ভারতে - পাওয়া যেত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু আবিষ্কৃত হয়নি।


∎ (৫) মিশ্র-সভ্যতা: উল্লিখিত আলোচনা থেকে বলা যায়, হরপ্পা-সংস্কৃতির স্রষ্টা কারা, ■ এই সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে সিন্ধু-উপত্যকার ধ্বংসাবশেষ ■ থেকে প্রাপ্ত অস্থি, খুলি প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে পন্ডিতেরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, উল্লিখিত ■ অঞ্চলে আদি-অস্ট্রেলীয়, ভূমধ্যসাগরীয়, আলপাইন ও মোঙ্গলীয়-এই চার প্রকারের লোকের অবস্থান ছিল। 

Post a Comment

Previous Post Next Post