প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিচিত্র সাহিত্য-সূত্রের উল্লেখ যায়।
করা (১) বৈদিক সাহিত্য: প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে বৈদিক সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ। 'চতুর্বেদ', 'সূত্র-সাহিত্য', 'বেদাঙ্গ' প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে আর্যদের বসতি বিস্তার, সমাজজীবন, কৃষিবাণিজ্য, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
(২) বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ: খ্রিস্টপূর্ব যুগের ভারত-ইতিহাস রচনার একটি প্রধান উপাদান হল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসাহিত্যগুলি। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। 'জাতক'-এর কাহিনিগুলি থেকে বুদ্ধের জীবন ও সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার কথা জানা যায়। উইন্টারনিজ (Winternitz)-এর মতে, "কেবল সাহিত্য হিসেবেই নয়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অব্দের সভ্যতার ইতিহাসে 'জাতক' কাহিনিগুলি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।" সিংহলীয় বৌদ্ধ সাহিত্য 'দীপবংশ' ও 'মহাবংশ' থেকে বুদ্ধের জীবনী ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশপরিচয় সম্বন্ধে বহু তথ্য পাওয়া যায়। 'ললিত-বিস্তর' ও 'বৈপুল্য-সূত্র' থেকেও বুদ্ধের জীবনী সম্পর্কে জানা যায়। জৈন গ্রন্থগুলির মধ্যে 'ভগবতী-সূত্র' ও 'আচারঙ্গ-সূত্র' থেকেও বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।
(৩) পুরাণ সাহিত্য: প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে 'পুরাণ'-সমূহের অবদান অনন্য। এজন্য একে ইতিহাস-পুরাণ বলা হয়। আঠারোটি পুরাণের মধ্যে পাঁচটির ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। অবশ্য ভিনসেন্ট স্মিথ ও এফ, পাজিটার প্রমুখের মতে,
পুরাণে কিংবদন্তী ও ঐতিহাসিক তথ্য এমনভাবে মিশে আছে যে, খুব সতর্কতার সাথে গ্রহণ না-করলে ভুল তথ্য এসে যেতে পারে। তা ছাড়া, পুরাণে বর্ণিত সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী বা তারও আগের অথচ পুরাণ সংকলিত হয়েছে সম্ভবত গুপ্তযুগে। তাই এতে কল্পনার প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। অন্যদিকে আর. সি. হাজরা গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রাচীন কালের ইতিহাস রচনায় পুরাণের সাহায্য নিশ্চিন্তে গ্রহণ করা যেতে পারে।
(৪) মহাকাব্য: ভারতের দুই জনপ্রিয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত থেকেও বহু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। এগুলি থেকে প্রাচীন রাজবংশগুলির কীর্তিকলাপ, সভ্যতার বিস্তার ইত্যাদি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য রামায়ণের ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে মহাভারতের ইতিহাস-মূল্য স্বীকৃত। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধকে 'ঐতিহাসিক ঘটনা' বলেই মনে করা হয়।
(৫) জীবনচরিতঃ প্রাচীন যুগে রচিত জীবনচরিতগুলিও ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে মূল্যবান। এগুলির মধ্যে বাণভট্টের 'হর্ষচরিত', কলহন-এর 'বিক্রমাঙ্কদেব-চরিত', বিশাখদত্তের 'মুদ্রারাক্ষস', সন্ধ্যাকর নন্দীর' রামচরিত', বাষ্পতির 'গৌড়বহো', পদ্মগুপ্তের 'নবশাহশাঙ্ক-চরিত', ন্যায়চন্দ্রের 'হাম্বির কাব্য', বল্লাল রচিত 'ভোজ-প্রবন্ধ' প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইসব রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য রাজাদের গুণকীর্তন হলেও, সমসাময়িক বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এগুলি থেকে আহরণ করা যায়।
(৬) রাজতরঙ্গিণী: প্রাচীন যুগে কোনো কোনো রাজা ধারাবাহিক ইতিহাস রচনারও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই প্রসঙ্গে কলহন বিরচিত 'রাজতরঙ্গিণী' বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থ রচনায় কন্ন্ সমসাময়িক বহু গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। এই গ্রন্থ থেকে কাশ্মীরের কার্কোট নাগ বংশের ইতিহাস জানা যায়।
(৭) সংস্কৃত সাহিত্যঃ সমসাময়িক কালে রচিত বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্য ও নাটকাবলি থেকেও প্রাচীন যুগের বহু তথ্য পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র' একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এতে রাষ্ট্রপরিচালনা ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বহু তথ্য আছে। বাৎস্যায়নের 'কামসূত্র', পতঞ্জলির 'মহাভাষ্য', গাগী সংহিতা' প্রভৃতিগ্রন্থও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহায্য করে